search the site
মানুষ মানুষের জন্যে ( একটি মানবিক আবেদন )
মিনার রশীদ
মেরিন একাডেমিতে জুনিয়র লাইফে Cadet’s Talk এ বঙ্কিম চন্দ্রের কাছ থেকে ধার করে একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছিলাম । বিষয়টি ছিলো, ডিফারেন্স বিটুইন বিপদ এন্ড আপদ । ইংরেজিতে অনুষ্ঠিত সেই ক্যাডেটস টকটিতে দুটি বাংলা শব্দ উচ্চারণ না করে উপায় ছিল না । ক্যাডেটস টকটি কোন মতে পার করলেও কিছুক্ষণ পরেই টের পেলাম , বিপদ এবং আপদ আসলেই কত প্রকার ও কী কী । বিপদ ও আপদের মধ্যকার পার্থক্যটি যথাযথ উদাহরণ সহ ২০তম ব্যাচের শ্রদ্ধেয় সিনিয়ররা সেদিন ঠিকঠাকমতই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন । মজার ব্যাপার হলো , সেটা বোঝানোর জন্যে তাদেরকে আজ শত্রু বলে মনে হয় না । কেমন যেন বন্ধু বন্ধু বলে মনে হয় ।
এই ফোরামে আজকেও বাংলায় কিছু কথা বলতে হচ্ছে দেখে আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি । মনে হচ্ছে কমিউনিটি হিসাবে মেরিনাররা এমন বিপদ – আপদে এর আগে খুব কমই পড়েছে । এমনিতেই ক্যাডেট ও জুনিয়র অফিসারদের চাকুরির সমস্যা । এখন মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসাবে এসেছে নাইজেরিয়ার জেলে আটক চার জন বাংলাদেশী সিফেয়ারারকে মুক্ত করার বিষয়টি চলে এসেছে ।
ভালো লেগেছে এই মানবিক আবেদনে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মেরিনারদের পক্ষ থেকে স্বত:স্ফুর্ত সাড়া দেখে।
ক্যাপ্টেন মেহেদি বিল্লাহ (১৭) ও খাদেমুল ইনসান ভাই (২০) সহ অন্যদের সাড়া দেখে সত্যিই অভিভূত হয়েছি। একাডেমির স্মৃতি স্মরণ করে কিছুটা নষ্টালজিকও হয়ে পড়েছি । আমাদেরকে ( জুনিয়রদের ) একটু বেশি যন্ত্রণা দিয়েছিলেন দেখে মেরিন একাডেমির শ্রদ্ধেয় চীফ এডুকেশন অফিসার মি: নুরুল আমিন একদিন কিছুটা প্রশ্রয় মিশ্রিত সুরে বকাঝকা করেছিলেন , ‘ খাদেম ! ইউ আর নো মোর খাদেমুল ইনসান , নাউ ইউ বিকেইম খাদেমুশ শয়তান ! ‘
মি: আমিনের আত্মা এই দৃশ্য দেখে নিশ্চয়ই খুশী হচ্ছে , তিনি হয়তোবা দেখছেন তাঁর প্রিয় ছাত্র খাদেমুল ইনসান নামের যথার্থতা প্রমাণ করেছেন ।
আজ আমাদের এই বড় ভাইটি একটু বিব্রত হতে পারেন – তার পরেও এই ঘটনাটি প্রকাশ করার লোভটি সামলাতে পারলাম না । তবে যে লোভটি সামলিয়েছি তা হলো – নিজেদের এই বিলাপ বা বিপর্যয়ের কথাটি কোন পাবলিক ফোরামে তুলে ধরি নাই ।
কারণ , যতদূর মনে পড়ে আমাদের একাডেমির সিনিয়র লাইফে অথবা তার কিছুদিন পরে ঢাকার বিখ্যাত একটি কলেজের মেয়েদের উপর একটা সার্ভে পরিচালনা করা হয়েছিল । বর হিসাবে কোন পেশার ছেলে পছন্দ – এমন প্রশ্নে সবার টপে ছিল মেরিন ইঞ্জিনিয়ার !!!
আজ ভয় হচ্ছে , বেকার ক্যাডেট ও জুনিয়রদের চাকুরির ব্যবস্থা করতে গিয়ে ওদের বিয়ের বাজারের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছি কি না ।
জুনিয়র অফিসার ও ক্যাডেটদের চাকুরির সংকট , জলদস্যুর হাতে জাহানমনি সহ অন্যান্য জাহাজ আটক , নাইজেরিয়ার জেলে আটক চার নাবিক এসব প্রচারণার নেগেটিভ ইফেক্ট সম্পর্কেও আমাদের একটু ভাবা দরকার । আমাদের দেশে এই প্রফেশনের একটা আলাদা মর্যাদা বা ডিগনিটি ছিল তা আমরা অনেকটাই খুঁইয়ে বসেছি । মানুষ শুধু ভোগের কাঙাল নয় , সম্মান ও ইজ্জতেরও কাঙাল ।
অনেকেই এই ব্যাপারে সরকারের অনুদান বা কৃপাদৃষ্টির কথা উল্লেখ করেছেন । কিন্তু মিডিয়ার প্রচারণা ছাড়া সেই কৃপা দৃষ্টি লাভ কখনই সম্ভব হবে না। তখন খাজনার চেয়ে এই বাজনা আমাদের জন্যে অত্যন্ত বেদনাদায়ক হয়ে পড়বে । তবে আইনগত এবং আন্ত:দেশীয় যোগাযোগের কিছু কিছু জায়গায় সরকারের সহযোগিতা অস্বীকার করা যাবে না ।
আন্তর্জাতিক পরিসরে আমাদের সরকারগুলোর ( এযাবৎ সব সময়ের সরকার ) প্রভাব সম্পর্কে আমরা একটু বেশি ধারণা পোষণ করি । অনেক লেফট রাইটের পর বাস্তব ফলাফল অনেক ক্ষেত্রেই বিরাট বড় একটা শূণ্য হয়ে পড়ে ।
তবে একজন ব্যক্তি আমাদেরকে এই ব্যাপারে সহায়তা করতে পারেন । তিনি হলেন ড: মুহাম্মদ ইউনূস । আমি আমাদের একজন জুনিয়রকে জানি যার সাথে ড: মুহম্মদ ইউনূসের পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে । এই ফোরামের পক্ষ থেকে তার প্রতি অনুরোধ তিনি যেন এই কঠিন সংকটে এগিয়ে আসেন । তাছাড়া সোহরাওয়ার্দি স্যার আমেরিকান প্রশাসনে উনার যোগাযোগগুলি কাজে লাগিয়ে সাহায্য করতে পারেন । ফোরামের পক্ষ থেকে তার প্রতিও এই অনুরোধটি রাখছি ।
এই সকল প্রচেষ্টার সাথে তহবিল সংগ্রহের ড্রাইভটিও যেন একেবারে থেমে না যায় । সবাই যার যার সামর্থে এগিয়ে আসুন। বিকল্প পথে সমাধান হয়ে গেলে এই টাকা কমিউনিটির অন্য কোন ইমার্জেন্সি মোকাবেলায় জমা থাকবে ।
এই ধরনের মহত কাজের নগদ প্রাপ্তিটি হলো Community bond and Strength অনেক বেড়ে যায় । ১৬তম ব্যাচের একজন ক্যাপ্টেনের অসুস্থতার সময়ে তাঁর ব্যাচমেইট এবং কমিউনিটির সাড়া উদাহরণ হয়ে রয়েছে । আমার জানা মতে নাইমুর রশীদ স্যার পুরো বাসাটি ( ভাবি দেশে ফিরে যাবার পর নিজে ব্যাচেলর হয়ে যাবার পরেও ) দীর্ঘ দিন সেই বন্ধুর পরিবারের জন্যে রেখে দিয়েছিলেন । ঘটনাক্রমে ক্যাপ্টেন মেহেদি বিল্লাহ এবং নাইমুর রশীদ স্যারের সাথে একই জাহাজে সেইল করার সৌভাগ্য হয়েছে এবং তাদের মহৎ হৃদয়ের স্পর্শ খুব কাছ থেকে অনুভব করেছি ।
বিভিন্ন জন বিভিন্ন উপায় বাতলে দিচ্ছেন । পুরো প্রসেসে যেন কোন খুঁত না থাকে সেজন্যে কেউ কেউ সাবধান করে দিচ্ছেন । তাতে সামান্য কনফ্লিক্টও সৃষ্টি হচ্ছে । মতের ভিন্নতা থাকলেও সকলের টার্গেট কিন্তু একই – যেভাবেই হোক এই চার জন বিপন্ন ও অসহায় মানুষকে উদ্ধার করা । এই মানুষগুলো কেউ নয় – তারা আমাদেরই একান্ত আপন জন । তারা কষ্ট পেলেনএকই ভাষায় ‘মাগো ‘ বলে ডাকে , তারা আমার আপনার মত একই বিলজের পানি খেয়েছে , একই ঢং এ জাহাজে বসে পরিবারের সুখ শান্তি নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে ।
লেখালেখির সাথে জড়িত থাকায় এই ফোরামের বাইরের অনেক কথাই কানে এসেছে । নাইজেরিয়ান জেলে চারজন নাবিকের যন্ত্রণার সমান না হলেও মানসিক যন্ত্রণায় কাছাকাছি রয়েছে কয়েক শ বেকার ক্যাডেট ও জুনিয়র অফিসার । এই মুহুর্তে তাদের কথাও ভুলে গেলে চলবে না । মেরিন কমিউনিটির আজ সর্বাঙ্গে ব্যাথা -এখন ওষুধ লাগাবো কোথায় ?
এক সাথে সব ব্যাথা দূর করা সম্ভব হবে না । অনেক জায়গায় কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট সৃষ্টি হয়েছে । এই সব স্বার্থের কিছু বৈধ , কিছু অবৈধ , আবার কিছু অনৈতিক হলেও অবৈধ নয় । এটা সত্য যে মূল সমস্যা যারা সৃষ্টি করেছে তাদের কোন মানসিক পীড়ন নেই । এদের শরীরে কিছু সেন্সর কম থাকে বলে এরা সব সময় আরামে থাকে । এরা সব কমিউনিটি , সব জায়গাতেই আছে ।
নেপোলিয়ন যথার্থই বলেছেন , অসৎ লোকের কর্মকান্ডে সমাজ ধ্বংস হয়না । সমাজ ধ্বংস হয় ভালো লোকের নিষ্ক্রিয়তায়। আমাদের ক্ষেত্রেও হুবহু তাই হয়েছে।
পেছনে নয় , আমাদেরকে সামনে এগুতে হবে ।
এদেরকে আইডেন্টিফাই করতে হবে , সবাইকে সজাগ ও ভোকাল হতে হবে যাতে নতুন করে কোন সমস্যা সৃষ্টি করতে না পারে । আসুন, সবাই ধীরে ধীরে নিজের ব্যবসা ও চাকুরি নিয়ে নৈতিকতা ও স্বচ্ছতার পানে অগ্রসর হই ।
আর যে ভালো কাজটি শুরু করেছি তা সম্পন্ন করে সেই শক্তি (Community) সমস্যা গুলি একে একে সমাধান করি ।