করোনায় জাহাজী জীবন

Comments Off on করোনায় জাহাজী জীবন

এপ্রিল ১১, ২০২১ / সর্বশেষ সংশোধিত: ০২:৩০ অপরাহ্ন, এপ্রিল ১১, ২০২১

প্রবাসে

করোনায় জাহাজী জীবন

ছবি: আব্দুল্লাহ-আল-মাহমুদআব্দুল্লাহ-আল-মাহমুদ

করোনায় সারা পৃথিবী বিপর্যস্ত। প্রায় দেড় বছর হতে চলল করোনার তাণ্ডবলীলার। করোনায় কখনো কখনো বিমান, বাস, ট্রাক এসব চলাচল বন্ধ হলেও একমাত্র জাহাজ আর জাহাজীদেরই থেমে থাকার সুযোগ ছিল না। এখনো নেই। কারণ পৃথিবীর ৯০ ভাগ পণ্য জাহাজে পরিবাহন করা হয়। পৃথিবীর মানুষের নানা পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে তাই জাহাজ চলাচল করতেই হবে। তবে করোনা আমাদের ছুঁয়ে গেছে নানাভাবে।  

করোনার শুরুর দিকে বেশিরভাগ দেশই সব ধরনের ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছিল। ফ্লাইট বন্ধ হওয়ার পর সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হয়েছে সম্ভবত মেরিনাররা। যেহেতু আমাদেরকে বেশিরভাগ সময় দেশের বাইরে থেকে জাহাজে উঠা-নামা করতে হয়, তাই আমরা বিমানের উপরই পুরোপুরি নির্ভরশীল। এছাড়াও করোনাকালীন সময়ে যে দেশ থেকে জয়েন করতে হবে বা নামতে হবে সে দেশের নিয়মও বিবেচনার বিষয়। তো সবকিছু মিলিয়ে করোনায় মেরিনারদের বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে জাহাজে উঠা-নামা নিয়ে। কারণ প্রতিটি দেশ প্রতিনিয়ত করোনার জন্য নিয়ম-কানুন পরিবর্তন করছে। এত নিয়ম কানুন, রেস্ট্রিকশনের জন্য দেখা যাচ্ছে অনেক মেরিনার দেড় বছর, এমনকি অনেকে দুই বছর যাবৎ জাহাজে আটকে আছে। কোম্পানি চাইলেও নামাতে পারছে না।

আবার একইভাবে অনেক মেরিনার দীর্ঘ সময় দেশে আছে জাহাজে ফেরার অপেক্ষায়। অনেকে আবার করোনা পজিটিভ হওয়ায় জাহাজে জয়েন করতে পারেনি। ভুল রিপোর্টের জন্য জয়েন করতে ব্যর্থ হয়েছে এমন ঘটনাও আছে। যদিও সম্প্রতি দীর্ঘদিন জাহাজে আটকে থাকা মেরিনারদের মানসিক এবং শারীরিক অবস্থা অনুধাবন করে বেলজিয়াম, ফ্রান্স, কানাডা, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশসহ উন্নত বিশ্বের প্রায় ৪৫টি দেশ মেরিনারদেরকে ‘কী-ওয়ার্কার’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর ফলে মেরিনাররা একদেশ থেকে অন্যদেশে ভ্রমণের সুযোগ পাচ্ছে জাহাজে জয়েন করা বা জাহাজ থেকে নিজ দেশে ফেরার জন্য।

বাংলাদেশে করোনার জন্য লকডাউন ঘোষণা করার অল্প কিছুদিন আগে আমি জাপান থেকে দেশে ফিরেছিলাম। ২০২০ এর ফেব্রুয়ারিতে যখন সেন্দাই থেকে দেশে ফিরছিলাম তখনই মাস্ক ব্যবহার করতে হয়েছিল। এরপর দেশে ফিরে লকডাউনের জন্য পুরোপুরি গৃহবন্দী। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমার স্ত্রী-কন্যাও সিডনি বেড়াতে গিয়ে লকডাউনের কবলে পড়ে। ওরা লকডাউনে অস্ট্রেলিয়া আর আমি বাংলাদেশে! করোনার তাণ্ডবলীলা দেখে ভয় পেয়েছিলাম যে ওদেরকে আর দেখার সুযোগ পাবো কিনা। পরে আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি জাহাজে জয়েন করার মাস চারেক আগে ওরা দেশে ফিরতে সক্ষম হয়।

এবার আমি প্রায় সাড়ে নয় মাস অপেক্ষার পর সিঙ্গাপুর থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে জাহাজে জয়েন করি। জাহাজে জয়েন করার আগে আমাকে ১৪ দিন হোম-কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়েছিল সিঙ্গাপুরের নিয়ম অনুযায়ী। কোম্পানি থেকে সকাল-বিকেল দু’বেলা ভিডিও কল করা হতো, তাপমাত্রা মেপে জানাতে হতো। করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেটের সাথে হোম কোয়ারেন্টিনের সেই টেম্পারেচার লগও জয়েনিংয়ের সময় বহন করতে হয়েছিল। করোনার আগে খুব সহজে ভিসা-ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করা গেলেও এবার অনেক বাড়তি ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল। যেমন, অন্যান্য সময় শুধু ভিসা থাকলেই সিঙ্গাপুর ফ্লাই করা যেত। কিন্তু এবারে শুধু ভিসাই যথেষ্ট ছিল না, ফ্লাই করার আগে সিঙ্গাপুরের এপ্রুভাল, করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেটও বাধ্যতামূলক ছিল। সিঙ্গাপুর যাবার সময় আমার ট্রানজিট ছিল কুয়ালালামপুরে। এয়ারপোর্ট এবং বিমান দু’জায়গাতেই এত কমসংখ্যক যাত্রী ছিল যা করোনার আগে কখনো দেখিনি।

করোনার জন্য প্রতিটি জাহাজে এখন অনেক বেশি সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। এবার জাহাজে পৌঁছানোর পর আমার সাথে থাকা সব লাগেজ জীবাণুমুক্ত করে এরপর কেবিনে পৌঁছে দেয়া হয়। কেবিনে ঢোকার আগে আমাকেও জাহাজের হাসপাতালে গোসল করতে হয়েছিল সতর্কতার অংশ হিসেবে! বর্তমানে প্রায় প্রতিটি বন্দরে পৌঁছানোর পরপরই জাহাজের সবার টেম্পারেচার চেক করা হচ্ছে অথরিটি থেকে। জ্বর বা করোনার অন্য কোন উপসর্গ আছে কিনা জিজ্ঞেস করছে। জাহাজেও নিজেদের মধ্যে যতটা সম্ভব নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে, মাস্ক ব্যবহার করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। অনেক দেশের পোর্টে PCR টেস্টও করা হচ্ছে বাড়তি সতর্কতা হিসেবে।

করোনায় কিছু কিছু দেশ যেমন ফিলিপাইন, পাকিস্তান, সাউথ কোরিয়া তাদের মেরিনারদের করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট ছাড়াই দেশে ফেরার অনুমতি দিয়েছে। নিজ দেশে পৌঁছানোর পর কভিড-১৯ টেস্ট করা হয়, নেগেটিভ হলে এরপর নিজ বাড়ি যেতে কোন বাধা থাকে না। পজিটিভ হলে সরকার নির্ধারিত আইসোলেশন সেন্টারে থাকতে হবে যতদিন না নেগেটিভ হচ্ছে। যদিও বাংলাদেশি মেরিনারদের জন্য তেমন সুযোগ নেই। আমাদেরকে যে দেশ থেকে নামতে হবে সেখানে আগে টেস্ট করে করোনা নেগেটিভ হলেই কেবল দেশে ফিরতে পারব।

আবার কিছু দেশ যেমন সিঙ্গাপুরে মেরিনারদেরকে ‘ফ্রন্টলাইনার’ হিসেবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে যে সুযোগ বাংলাদেশি মেরিনাররা পাচ্ছে না। আমার ধারণা কিছুদিন পর বিশ্বের সমস্ত দেশে ভ্রমণের জন্য বাধ্যতামূলক করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেটের মতো কভিড-১৯ ভ্যাকসিনও বাধ্যতামূলক করবে। তেমনটা হলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন না পাওয়া বাংলাদেশি মেরিনাররা যে সমস্যায় পড়বে তা সহজেই অনুমেয়।

আমরা জাহাজে থাকাবস্থায় বাইরের দুনিয়া থেকে মোটামুটি আইসোলেটেড থাকায় নিজেরা তুলনামূলকভাবে বেশি নিরাপদে থাকলেও দেশে রেখে আসা আমাদের পরিবার-পরিজনদের জন্য সবসময় দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। পরিবারের কেউ করোনা আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে জাহাজ থেকে আমাদের সেভাবে সাপোর্ট দেয়ার সুযোগ নেই। জাহাজে থাকাবস্থায় অনেক মেরিনার তাদের প্রিয়জনদের হারিয়েছে এই করোনায়। পরিস্থিতি প্রতিকূল হওয়ায় তাদের প্রায় সকলেই শেষবারের মতো প্রিয় মুখগুলো দেখার সুযোগ পায়নি। সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছিল আমার এক সিনিয়রের সাথে। স্যার জাহাজ থেকে নেমেছিলেন উনার বাবা অসুস্থ হবার আগেই। কিন্তু যে দেশে নেমেছিলেন সে দেশের নিয়ম ছিল, কোন মেরিনার জাহাজ থেকে নামার পর ১৪ দিন হোটেলে থাকার পর নিজদেশে ফিরতে পারবে। স্যার হোটেলে থাকাবস্থায় যখন বাড়ি ফেরার জন্য দিন গুনছিলেন তখনই সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। কিন্তু সেদেশের করোনার নিয়মের মারপ্যাঁচে পরে জাহাজে না থেকেও দেশে ফিরে বাবার জানাজায় অংশগ্রহণ করতে বা বাবাকে শেষবারের মতো দেখতে পারেননি। যদিও প্রিয়জনের অসুস্থতায় বা মৃত্যুতে অন্যান্য প্রবাসীদের মতো মেরিনাররা চাইলেই হুট করে দেশে ফিরতে পারে না। সুবিধাজনক পোর্ট, রিলিভার ইত্যাদি অনেক বিষয় কোম্পানিকে বিবেচনা করতে হয় জাহাজ থেকে নামানোর আগে। আগে অনেক মেরিনার বাবা-মায়ের মৃত্যুর খবরও সময়মতো পাননি, শেষ দেখা তো দূরের কথা।

জাহাজে থাকাবস্থায় জাহাজীদের রিফ্রেশমেন্টের জন্য সবচেয়ে সেরা যে উপায় ‘শোর লিভ’, করোনায় সেটা বেশিরভাগ দেশেই বন্ধ! কিছু কিছু দেশে যদিও শোরলিভে যাবার সুযোগ দিচ্ছে, কিন্তু বেশিরভাগ পোর্টে জাহাজেই পুরোপুরি বন্দীদশায় থাকতে হচ্ছে! জাহাজ থেকে পা নামানোর কোন সুযোগই নেই। ফলে জাহাজেই যতটা সম্ভব বিভিন্ন ধরনের গেমস, পার্টির আয়োজন করছে বিনোদনের জন্য। টেবিল টেনিস টুর্নামেন্ট, বাস্কেটবল, শুটিং কম্পিটিশন শেষ হলো কয়েক সপ্তাহ আগেই।

বাইরে যাবার সুযোগ না থাকায় খাবারের স্বাদে ভিন্নতা আনতে কয়েকদিন পরপর নিজেরাই বিভিন্ন দেশীয় খাবার যেমন খিচুরি, পোলাও, ইলিশ মাছ, শুটকি ভর্তা, আলু ভর্তা ইত্যাদি রান্না করি। জাহাজের ভিনদেশী ক্রুরাও আমাদের সাথে যোগ দেয় খাওয়ার সময়। ইতোমধ্যে ফিলিপিনো, ইন্ডিয়ান আর কোরিয়ান অনেকে বাংলাদেশি পোলাও আর খিচুরির ভক্ত হয়ে গেছে!

সারাবিশ্বের মতো জাহাজীদের জীবনেও করোনা অনেক নতুন নতুন অভিজ্ঞতা-পরিস্থিতির সম্মুখীন করছে যা কেউ কখনো কল্পনা করেনি। আশা করছি খুব শিগগির আমরা করোনাকে জয় করে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবো যেখানে না থাকবে কোন মাস্ক, না থাকবে কোন সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার বাধ্যবাধকতা! আমার মতো সমস্ত জাহাজী সেই দিনের অপেক্ষায় আছে, যেদিন আবার আমাদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠবে পৃথিবীর সমস্ত বন্দর আর বন্দরের আশেপাশের দর্শনীয় স্থানগুলো।

লেখক: আব্দুল্লাহ-আল-মাহমুদ, এক্স-ক্যাডেট, বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি, ৪৭তম ব্যাচ, বিটিএস ক্যাপেলা’ জাহাজ থেকে

Comments are closed.