নৌ অধিদপ্তরের অবৈধ এনওসি তদন্তে গড়িমসি নিয়ে নানা প্রশ্ন

Comments Off on নৌ অধিদপ্তরের অবৈধ এনওসি তদন্তে গড়িমসি নিয়ে নানা প্রশ্ন

নিজস্ব প্রতিবেদক, পাঠকের কণ্ঠ

* ধরাছোঁয়ার বাইরে অভিযুক্ত কর্মচারি মিঠুন কুমার চাকী
* এ বিষয়ে সোচ্চার হওয়ায় বিপদাশঙ্কায় এক সাংবাদিক

তদন্তের বেড়াজালে আটকে আছে বিমানবন্দরে আটক নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের অবৈধ ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট (এনওসি)’ বা ছাড়পত্র আটকের ঘটনা। তদন্ত কমিটি গঠন ও পুনর্গঠন মিলিয়ে পর্যায়ক্রমে তিনজনকে কমিটির আহ্বায়ক করা হলেও কোনো কমিটিই এখনও প্রতিবেদন দেয়নি। ২০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার কথা থাকলেও এভাবেই কেটে যাচ্ছে ছয় মাসেরও বেশি সময়। এর ফলে নিজেকে নির্দোষ দাবি করার পরও অভিযুক্ত কর্মকর্তা ও অধিদপ্তরের পরীক্ষক এস এম নাজমুল হককে অহেতুক মানসিক যন্ত্রণায় রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

এদিকে চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা এবং অভ্যন্তরীণ নৌযানের মাস্টার ও ড্রাইভারদের জাল সনদ তৈরিসহ অনেক অপকর্মের সঙ্গে নৌ অধিদপ্তরের কর্মচারি মিঠুন কুমার চাকীর সম্পৃক্ততার জোরালো অভিযোগ উঠলেও তিনি রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তদন্ত কমিটির সদস্যরা এ পর্যন্ত তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ পর্যন্ত করেননি বলে জানা গেছে। গুঞ্জন উঠেছে, মিঠুন চাকীকে রক্ষায় কোনো অদৃশ্য শক্তির ইঙ্গিতে তদন্ত দীর্ঘায়িত করে নাজমুল হককে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন ও বিব্রত করা হচ্ছে।

তবে অভিযুক্তরা নিরাপদে থাকলেও বিপদাশঙ্কায় আছেন এক গণমাধ্যমকর্মী। এনওসি আটকের মতো স্পর্শকাতর ঘটনাটি প্রথম পত্রিকায় প্রকাশ করে দুর্নীতিবাজ দুষ্টচক্রের রোষাণলে পড়েছেন সাপ্তাহিক পাঠকের কন্ঠ ও অনলাইন নিউজপোর্টাল পিটিবিনিউজ.কমের প্রধান সম্পাদক আশীষ কুমার দে। পাঠকের কন্ঠ’র সূত্র ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে পরবর্তী সময়ে শীর্ষস্থানীয় একাধিক জাতীয় দৈনিক এই সংবাদ প্রকাশ করায় তাঁর ওপর অভিযুক্তদের ক্ষোভ অনেক বেড়ে যায়। সাংবাদিক আশীষ কুমার দে জানিয়েছেন, তাঁকে মিথ্যা মামলা বা ভাড়াটে পেশিশক্তিধারীদের দিয়ে অথবা অন্য কোনো উপায়ে ব্ল্যাকমেইলিং করে ঘায়েল করার ষড়যন্ত্র চলছে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে তিনি জেনেছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ঢাকার ইমিগ্রেশন পুলিশের জিডি নং- ৯০০ এর বরাত দিয়ে গত ২ জুন পুলিশের বিশেষ শাখার একজন বিশেষ পুলিশ সুপার (ইমিগ্রেশন) স্বাক্ষরিত পত্রে নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকে জানানো হয়, “ইমিগ্রেশন শাখা, স্পেশাল ব্রাঞ্চ, বাংলাদেশ পুলিশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধানের স্বার্থে নিম্ন বর্ণিত ব্যক্তির নামে ইস্যুকৃত এনওসি’র সঠিকতা যাচাই করা আবশ্যক। অত্র বিষয়ে তদন্তপূর্বক আপনার লিখিত মতামতসহ একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জরুরিভিত্তিতে অত্র অফিসে প্রেরণ করার জন্য অনুরোধ করা হলো।

পুলিশের বিশেষ শাখার এই পত্রের সঙ্গে প্রমাণস্বরূপ একটি ছাড়পত্র ও ছাড়পত্রধারী কথিত নাবিকের পাসপোর্টের ছায়ালিপি যুক্ত করা হয়। তাতে দেখা গেছে, ইংরেজিতে লেখা ওই ছাড়পত্রটি অধিদপ্তরেরই একজন কর্মকর্তা দিয়েছেন। তাঁর স্বাক্ষরের নিচে পুরো নাম ড. এস এম নাজমুল হক, ‘ইঞ্জিনিয়ার এ্যান্ড শিপ সার্ভেয়ার এ্যান্ড এক্সামিনার’ এবং ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নম্বর ০১৯৮৮-৭৭৭৭৮৮ উল্লেখ রয়েছে। ছাড়পত্রধারী ব্যক্তির পরিচয় লেখা রয়েছে- মো. মুজাহিদুল ইসলাম, পিতা- আলতাফ হোসেন খান, ইসলামীয়া কলেজ রোড, বয়রা, খুলনার। পাসপোর্ট নং এএফ ১৯৮৩৫৪৩। অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে এক্সামিনার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত এস এম নাজমুল হক নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ার এ্যান্ড শিপ সার্ভেয়ারের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। ছাড়পত্রে উল্লেখিত তাঁর ফোন নম্বরটিও সঠিক বলে জানা যায়। তবে শুরু থেকেই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন নাজমুল হক।

এনওসি কী? : সমুদ্রগামী জাহাজে নাবিকদের চাকরির স্বার্থে দ্রুত কর্মস্থলে পৌঁছানোর জন্য নাবিকরা নৌ পরিবহন অধিদপ্তর থেকে এনওসি বা ছাড়পত্র নিয়ে আকাশপথে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ পান। তবে এই সুযোগের অপব্যবহার করে অনেক বাংলাদেশী নাগরিক বিভিন্ন সময়ে বিদেশে গিয়ে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ায় তা লন্ডনস্থ আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থার (আইএমও) সদর দপ্তরের নজরে আসে। এরপর সেখান থেকে বিষয়টি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়। আইএমও’র অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র ও নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক যৌথ বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক গত দুই বছর যাবত এ ধরনের এনওসি বা ছাড়পত্র দেয়া বন্ধ করে দেয় নৌ পরিবহন অধিদপ্তর। ফলে বিদেশে চাকরিপ্রত্যাশী ও চাকরিপ্রাপ্ত নাবিকদের কর্মস্থলে যেতে হলে সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাস থেকে ভিসা নিতে হয়। তবে তিনটি মন্ত্রণালয়ের যৌথ বৈঠকের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে এভাবে ছাড়পত্র দেয়ার ঘটনা জানাজানির পর সংশ্লিষ্ট মহলে অভিযোগ ওঠে, মোটা অংকের টাকার বিনিময় এই ছাড়পত্র নিয়ে অনেক অপরাধীও দেশ ছাড়ার সুযোগ নিচ্ছে। তাই রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্তের জোরালো দাবি ওঠে।

তদন্ত কমিটি গঠন, পুনর্গঠন ও কালক্ষেপন : পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের লিখিত অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গত ১৪ জুন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। অধিদপ্তরের ঢাকা (সদরঘাট) কার্যালয়ের ‘প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক’ মীর্জা সাইফুর রহমানকে আহ্বায়ক এবং নির্বাহী হাকিম ও বিশেষ কর্মকর্তা (নৌ নিরাপত্তা) বদরুল হাসান লিটনকে সদস্য করে গঠিত দুই সদস্যের কমিটিকে ২০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। তবে বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পরপরই নৌ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অদৃশ্য কারণে তদন্ত কমিটি পুনর্গঠন করেন। পুনর্গঠিত কমিটির আহ্বায়ক করা হয় চট্টগ্রামের ‘নাবিক ও প্রবাসী কল্যাণ পরিদপ্তর’ এর পরিচালক নুরুল আলম নিজামীকে। তিনি তদন্তের নামে কালক্ষেপনের একপর্যায়ে গত অক্টোবরে অন্যত্র বদলি হন। এরপর চট্টগ্রামের নৌ বাণিজ্য দপ্তরের মূখ্য কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে কমিটি ফের পুনর্গঠন করা হয়। তবে তিনবার আহ্বায়ক বদল করা হলেও কমিটির একমাত্র সদস্য অধিদপ্তরের নির্বাহী হাকিম বদরুল হাসান লিটনকে অপরিবর্তিত রাখা হয়। কিন্তু শফিকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিটিও তদন্তের নামে কালক্ষেপন করছে। ২০ কার্যদিবসের স্থলে ইতোমধ্যে ৬ মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও তদন্ত কমিটি এখনো প্রতিবেদন দেয়নি।

নাজমুল হক যা বলেন : তদন্ত কমিটি গঠনের পর নাজমুল হক দৃঢ়তার সঙ্গে দাবি করেছেন, তিনি এ ধরনের কোনো এনওসি দেননি কিংবা আইন ও বিধিবহির্ভুত কোনো কাজের সঙ্গেই জড়িত নন। এ বিষয়ে তিনি পাঠকের কন্ঠকে বলেন, “বিভিন্ন দাপ্তরিক কাগপত্রে আমার বহু স্বাক্ষর রয়েছে। কোনো সুবিধাবাদী মহল বা জালিয়াতচক্র কম্পিউটারে ভূঁয়া এনওসি তৈরির পর আমার স্বাক্ষর স্ক্যান করে তাতে যুক্ত করেছে।” ঘটনার সঙ্গে নিজের জড়িত না থাকার পক্ষে শক্ত যুক্তি উত্থাপন করে নাজমুল হক আরো বলেন, “অধিদপ্তরের নথিতে ওই এনওসির অস্তিত্ব নেই। আটক এনওসিতে উল্লেখিত তারিখের স্মারক নম্বরের সঙ্গে অধিদপ্তরের নথির স্মারক ও তারিখের মিল নেই।”

সুষ্ঠু তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন : অবৈধ এনওসি-তে যে কর্মকর্তার স্বাক্ষর ও ফোন নম্বর পাওয়া গেছে সেই নাজমুল হক শুরু থেকেই দৃঢ়তার সঙ্গে বলে আসছেন, কোনো জালিয়াতচক্র কম্পিউটারে ভূঁয়া এনওসি তৈরির পর তাঁর স্বাক্ষর স্ক্যান করে সেখানে যুক্ত করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তথ্য-প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের এই যুগে বিষয়টি সহজেই প্রমাণ করা সম্ভব। বিতর্কিত এনওসির কপি তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠানো হলে ডিজিটাল পদ্ধতিতে পরীক্ষা যাবে যে, নাজমুল হকের স্ক্যানিংয়ের সুপার ইমম্পোজ করে সেখানে বসানো হয়েছে কিনা। কিন্তু তদন্ত কমিটি গুরুত্বপূর্ণ কাজটি না করে তদন্ত কার্যক্রম দীর্ঘায়িত করায় তাদের ভূমিকা নিয়ে জোরালো রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। কমিটির এই প্রশ্নবিদ্ধ কালক্ষেপনের কারণে স্পর্শকাতর একটি বিষয় ছয় মাসেরও বেশি ঝুলে আছে। অধিদপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হয়েও নাজমুল হক প্রচ- মানসিক চাপে রয়েছেন। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণের পর ঘটনার সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্তা পাওয়া না গেলে অভিযোগ থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেয়াই বাঞ্ছণীয় বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

এর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলেন, কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে এভাবে তদন্তের বেড়াজালে বন্দি রাখা সমীচিন নয়। এছাড়া নাজমুল হক দক্ষিণ কোরিয়া ও বাংলাদেশের যৌথ অর্থায়নে চলমান পৌণে ৪০০ কোটি টাকার গ্লোবাল মেরিন ডিস্ট্রেস্ড এন্ড সেফটি সিস্টেম (জিএমডিএসএস) প্রকল্পের পরিচালক। মানসিক যন্ত্রণা থাকলে তিনি গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পের কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে পারবেন না। এছাড়া তাঁর একটা সামাজিক মর্যাদাও রয়েছে। তদন্ত ঝুলে থাকলে বিভিন্ন সময়ে এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হবে এবং নাজমুল হক সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবেন। তবে তদন্ত কমিটি গঠনের পরপরই অধিদপ্তরের কর্মচারি মিঠুন কুমার চাকীর বিরুদ্ধে এই ঘটনাসহ অনেক জাল সনদ তৈরির অভিযোগ উঠলেও এ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ না করায় তদন্ত কমিটির সদস্যদের ভূমিকা নিয়ে জোরালো প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

তদন্ত কমিটির প্রধানকে নিয়ে বিতর্ক : আটক অবৈধ এনওসির ঘটনা তদন্তে সর্বশেষ পুনর্গঠিত কমিটির আহ্বায়ক চট্টগ্রামের নৌ বাণিজ্য দপ্তরের মূখ্য কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলামকে নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম, দুর্নীতিসহ বহু অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে ২০১৪ সালে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির অভিযোগের পর নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। ওই কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছিল চট্টগ্রামের নাবিক ও প্রবাসী কল্যাণ পরিদপ্তরের তৎকালীন পরিচালক নুরুল আলম নিজামীকে। তিনি তদন্তের নামে দেড় বছর কালক্ষেপন করে কয়েক মাস আগে একপত্রে মহাপরিচাপলককে জানান, তিনি এই তদন্ত করতে অপারগ। এরপর অদৃশ্য কারণে শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে আর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি। সুতরাং শফিকুল ইসলামের মতো একজন বিতর্কিত কর্মকর্তার ওপর অবৈধ এনওসি আটকের ঘটনার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ের তদন্তভার দেয়ায় সুষ্ঠু তদন্ত নিয়ে জোরালো সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।

Comments are closed.